Tuesday, June 9, 2009

জলিলের বক্তব্যে তোলপাড়



- ঢাকা প্রতিনিধি, মাহবুবুল আলম

নৌকা থেকে কেউ নেমে গেলে তিনি হারিয়ে যান : সাজেদা , আমিই প্রথম শেখ হাসিনার মুক্তির কথা বলেছিলাম : আমু বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি কি বললো তা ধরতে নেই : সুরঞ্জিত

মন্ত্রিসভার অনেকেই ডিজিএফআইর পেইড এজেন্ট”­ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের এমন বক্তব্যে দলের ভেতরে-বাইরে ঝড় উঠেছেকেউ কেউ তার এ বক্তব্য দলের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করে বলেছেন, দলেরই সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে এ ধরনের বক্তব্যের অপরাধে আবুদল জলিলকে এখনই দল থেকে বহিষ্কারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজনএ দিকে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরই আবদুল জলিলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্খা গ্রহণ করা হবে বলে দলীয় একটি সূত্র থেকে জানা গেছে

এ দিকে আবদুল জলিলের বক্তব্যকে দলের অনেক নেতা দলীয় শৃঙ্খলাপরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেনদলের প্রেসিডিয়ামের সদস্যরা তার এই বক্তব্যকে সরকারের ভাবমর্যাদা বিনষ্টকারী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেনসেই সাথে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ ধরনের বক্তব্যকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী হিসেবে চি?িহ্নত করে এ জন্য আবদুল জলিলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি উঠেছেদলের বিভিন্ন পর্যায়ের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের চাপে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বেগম সাজেদা চৌধুরী গতকালই দলের জরুরি কার্যনির্বাহী সংসদের সভা আহ্বান করেছিলেনকিন্তু দলীয় সভানেত্রীর সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় পরে তা আবার স্খগিত করা হয়

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের বক্তব্যের এক প্রতিক্রিয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি দলের সাধারণ সম্পাদক জলিল সাহেবের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেয়া কি ঠিক হয়েছে? নেত্রী দেশে ফিরলেই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বডি কার্যনির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করা হবেওই সভায় তার বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হবে এবং দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্খা গ্রহণ করা হবে

তিনি বলেন, আবদুল জলিল পার্টিতে থেকে পার্টির বিরুদ্ধেই কথা বলেছেনহঠাৎ করে পার্টির বিরুদ্ধে কেন তার বিষোদগার তা আমার বোধগম্য নয়

আবদুল জলিলের দেয়া বক্তব্যে ডিজিএফআইদালালশব্দ প্রসঙ্গে প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জলিল সাহেবের মুখে ডিজিএফআই শব্দটি বারবার শুনছিকিভাবে দালালি করে আমরা তা বলতে পারব নাডিজিএফআইর দালাল কারা তা ডিজিএফআই সদস্যরাই জানেনঅন্য কারো জানার কথা নয়গতকাল বুধবার তার ইস্কার্টনস্খ বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি আরো বলেন, আমি কখনো সংস্কার প্রস্তাব দেইনিআওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফতার হওয়ার পর গত ১ নভেম্বর ২০০৭ থেকে আমি সিঙ্গাপুরে ছিলামমাঝে একবার আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর দেশে এসেছিলামএরপর আবার একবার দেশে এসেছিলামতখন আমি মিডিয়ার সামনে দু-একটি কথা বলেছিলামতবে নেত্রীকে মাইনাস করার ব্যাপারে কোনো কথা বলিনিমিডিয়ার পক্ষ থেকে সংস্কারের ব্যাপারে প্রশ্ন এসেছিলআমি বলেছিলাম, সংস্কারের প্রস্তাব যদি কেউ দিতে চায় তাহলে সেটা দিতে হবে কার্যনির্বাহী কমিটির সভায়সেখানে সংস্কারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবেআর ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা

আবদুল জলিল যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দলের এবং নেত্রীর বিরুদ্ধে চলে গেছে

আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে না পেরে জলিল সাহেব সংক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধবিক্ষুব্ধ ব্যক্তি কী বলল তা ধরতে নেইজলিল সাহেবের এই সমস্যা সঙ্কটে পরিণত হয়েছেআশা করি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ সঙ্কটের সমাধান হবে

পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী নয়া দিগন্তকে বলেন, জলিলের এই বক্তব্য রাজনৈতিক শিষ্টাচারবিবর্জিতএ বক্তব্য দেয়ার পর তিনি এখন আর দলের সাধারণ সম্পাদক নেইতার এ বক্তব্য দলীয় ফোরামে দেয়া উচিত ছিলআওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় ডিজিএফআইর কোনো এজেন্ট নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল মন্ত্রিসভা, সংগঠন ও দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ায় সারাদেশ থেকে দলের নেতাকর্মীদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়বিভিন্ন পত্রিকায় তার বক্তব্য প্রকাশ হওয়ায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনপত্রপত্রিকায় খবরটি দেখে সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা সিনিয়র নেতাদের কাছে ফোন করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চানদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির কাছেও ফোন আসে অনেকএ পরিস্খিতিতে এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে দলের শীর্ষ ফোরাম কার্যনির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করেন তিনিতবে বৈঠক সম্পর্কে তিনি দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনকিন্তু এ সময় প্রধানমন্ত্রী ওমরাহ পালনে ব্যস্ত থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নিএ কারণে কিছুক্ষণ পরই বৈঠকটি আবার স্খগিত ঘোষণা করা হয়

দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গতকাল আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল আবদুল জলিলের এ বক্তব্যদলের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় দেশের বাইরে আছেনতবে হঠাৎ করে আবদুল জলিল এভাবে কেন জ্বলে উঠলেনএটি কি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে নিûক্রীয় করে রাখার বহি:প্রকাশ, না পেছন থেকে অন্য কোনো মদদ আছে তা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা চলে

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এমপি গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ওয়ান-ইলেভেনে ডিজিএফআইর (সামরিক গোয়েন্দা সংস্খা) দালালি করে যারা সুবিধা নিয়েছে, তারা এখনো সুবিধা নিচ্ছেবর্তমান সরকারের মধ্যেও ওই সুবিধাভোগীরা রয়েছেবর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় অনেক মন্ত্রী রয়েছেন যারা ডিজিএফআইপেইড এজেন্টতিনি বলেন, দক্ষ ও ত্যাগী নেতাদের নিûিক্রয় করে রাখায় বর্তমানে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকা মোটেও ভালো হচ্ছে নাএই সুযোগে অনেক সুবিধাভোগী ঢুকে দলের ক্ষতিসাধন করছে

দিলকুশায় নিজের বাণিজ্যিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে আবদুল জলিল ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে জানান, জেলে থাকাকালে কোন প্রেক্ষাপটে, কিভাবে ডিজিএফআই কর্মকর্তারা চিঠিতে তার স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলেনতিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতাসহ অনেকে ডিজিএফআইর দালালি করেছেকথাগুলো বলতে গিয়ে তিনি অনেকটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েনক্ষুব্ধ গলায় তিনি বলেন, সব ব্যাটা ওই সময় ডিজিএফআইর দালালি করেছেকে দালালি করেনি, সাহস থাকলে বলুনআমু, রাজ্জাক, তোফায়েল, সুরঞ্জিত সবাই দালালি করেছেতখন কারা কারা সকাল-বিকেল গুলশানে যেত তা কি আমরা জানি না? সৈয়দ আশরাফের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, কারা ওই সময় সকালে ডিজিএফআইর সাথে মিটিং করে বিকেলে দলের মিটিংয়ে অংশ নিয়েছে তা দেশের মানুষ সবাই জানেপ্রথমে পালিয়ে কেন লন্ডনে গেল, পরে কোন নিশ্চয়তা পেয়ে আবার দেশে ফিরে এলো, দেশের মানুষ বুঝি তা বোঝে না!

আবদুল জলিল বলেন, আমার কী অপরাধ? আমি তার (শেখ হাসিনার) পক্ষে স্ট্যান্ড নেয়ার কারণেই কি এই শাস্তি? যারা ষড়যন্ত্র করল তারা ভালো থাকবে আর আমাকে শাস্তি পেতে হবে, এটা তো হয় নাআমার দলের কিছু নেতা সংস্কারের নামে যখন সক্রিয় হলো, আমি তখন নেত্রীর পক্ষে অবস্খান নিলামবললাম, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সংস্কার হবেতখন ডিজিএফআইকে বোঝানো হলো, জলিল সাহেবকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে এগোতে পারব না

আবদুল জলিল দাবি করেন, তাকে সক্রিয় করা হলে তিনি এক থেকে দুই মাসের মধ্যে দলকে চাঙ্গা করে তুলতে সক্ষম হবেনতিনি বলেন, যাদের উপদেশ নিয়ে শেখ হাসিনা চলছেন তারা কখনোই তার ভালো করতে পারবে না

আবদুল জলিল বলেন, কাউন্সিল হলে নতুন সাধারণ সম্পাদক হবে সেটা তো আমরা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিআমার দুবার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রয়োজন নেইএমনিতেই পাঁচ-সাত বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছিতবে আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের কাউন্সিল আয়োজনের দায়িত্ব পালন করতে চাইআমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে করালে সেটা খারাপ দৃষ্টান্ত হবেআওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের কথা বলেকিন্তু যদি এ রকম করেন তাহলে গণতন্ত্রের কথা আর বলবেন নাওটাকে বাস্কেটে ছুড়ে ফেলে দিন

ভালো সংগঠকদের নিûিক্রয় করে না রাখলে দলের বর্তমান এ অবস্খার সৃষ্টি হতো না উল্লেখ করে আবদুল জলিল বলেন, আওয়ামী লীগের দুর্বলতার সুযোগে অনেক সুবিধাভোগী দলে ঢুকে ভালোর অভিনয় করে ক্ষতি করছেভালো সংগঠক হিসেবে দলকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা সহজ কাজ নয়

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা লিখে দিনআমি তো সবই হারিয়েছিএখন আমি কাউকেই ভয় পাই নাআমি আমার জায়গায় থেকে ফাইটকরে যাবোঅন্যায়ের প্রতিবাদ করবদল থেকে বাদ দিলেও পার্লামেন্ট থেকে তো বাদ দিতে পারবে নাদরকার হলে আবার ভোটে যাবো, জনগণ আমার সাথে আছে

বর্তমানে দলীয় গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে দল চলছে উল্লেখ করে আবদুল জলিল বলেন, কাউন্সিল আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেতা পালন করতে দেয়া হবে নাএটা কোন ধরনের অন্যায়? আমি থাকতে দুই নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) মিটিং ডাকবে, তার স্বাক্ষরিত দাওয়াতপত্র আমাকে পাঠানো হবে, সেখানে আমি যাবো কেন? বর্তমানে দলীয় সভানেত্রী ছাড়া অন্য কারো ডাকে কোনো দলীয় কর্মকাে অংশ নেন না বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান

তাকে নিûিক্রয় করে রাখার কারণ জানতে চাইলে আবদুল জলিল বলেন, আমি শেখ হাসিনার সাথে কোনো অবিশñাসের কাজ করিনিকরেছি কি না তার কাছে জিজ্ঞাসা করুনজেলে থাকাকালে চিঠি দেয়া প্রসঙ্গে আবদুল জলিল বলেন, আমার স্ত্রী আমার মুক্তির আবেদন করে কয়েক লাইনের একটি চিঠি পড়েছেনওই সময় ডিজিএফআই থেকে ওই চিঠি সরবরাহ করা হয়েছেএকজন বন্দী মানুষকে দিয়ে চিঠি দেয়ানো কতটা আইনগত­ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, চিঠিতে স্বাক্ষর করানোর জন্য রাত ২-৩টা পর্যন্ত আমার ওপর অত্যাচার করা হতোডিজিএফআইর কর্নেল আফজাল ও কর্নেল সাঈফ হাসপাতালে (ল্যাবএইড) গিয়ে আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করতশেষে একদিন আমাকে বলা হলো, স্বাক্ষর না করলে আপনার স্ত্রী ও ছেলেকে গ্রেফতার করা হবেতখন আমি তাদের কথা চিন্তা করে স্বাক্ষর করি

No comments:

Post a Comment